রাত গভীর হওয়া শুরু করলে ব্যস্ততা বেড়ে যায়, ঠিক  যেখানে রাস্তা  মোড় নিচ্ছে, সেখান টায়। কয়েক টুকরো জড়ানো সংলাপ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ছে  একদিক ওদিক। আশে পাশের বাড়ির জানালার আলো সরল রেখার মত একমাত্রিক হয়ে তটস্থ।পাশের নালায় হটাত হড় হড় করে কিছু একটা পরে যায়, দুর্গন্ধ ঘুরপাক খায় চারদিকে। একটা নিষ্প্রভ আলোয় দেখা যায় রক্তের শীর্ণ ধারা কাঠের পাটাতনের উপর থেকে ছড়িয়ে যায় আস্ফাল্টের উপর। ঘেয়ো কুকুরটাও তা তে মুখ দেয় না, একবার শোঁকে ফিরে গিয়ে আলোর নিচে বসে থাকে।
একটা রোগা লোক টলতে টলতে বেড়িয়ে আসে, চাঁদের আলোয় মুখটা জলে ভেসে আসা মৃতদেহর মত ফ্যাকাশে। একটা হাসির হুল্লড় উঠে আসে রাস্তায় বসে থাকা ছায়াগুলো থেকে,ঘুরপাক খেতে খেতে থাকে। মাঝে মাঝে কয়েকটা জানালা খুলে যায়, ছিটকে বেরয় কিছু আওয়াজ, হিন্দি গান, ঝগড়া, কখনও বা হাঁক ডাক, নতুন লোকের জন্য।

মোড়টা পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই বড় রাস্তা। বড় বড় বাড়ি।খোপ খোপ বারান্দা বলে দেয় এখানে অনেক গুলো পরিবারের ঠিকানা। জানালা দিয়ে চোখে পরে রান্নাঘরের  ব্যস্ততা। টি ভি তে চলতে থাকা সিরিয়েল, রাত ন’টার খবর, বাচ্চার চিৎকার, সব কিছু  রঙ উঠে যাওয়া পর্দা ঠেলে বেরিয়ে আসে। হতশ্রী গাছের টব, বারান্দার রেলিং এ নেতিয়ে থাকা শাড়ি। বিকেলে ধুয়ে দেয়া বোধহয়। দূর থেকে ঠেকলে, দাবার ছক মনে হয়  বাড়িটা কে। কিছু  জানালায় ফটফটে আলো, কয়েকটায় মিট্মিটে হলদে বাল্ব, কোনটা বা নিকষ অন্ধকার। জানালা দেখেই বলে দেয়া যেতে পারে যে কার আয় কেমন, কার মাসের শেষে হিসেবে করতে হয়, কার নয়।

মোড়ের এপারে আর ওপারে অনেক ফারাক। আর লোকেরা সেই ফারাকটা স্বযত্নে মেনে চলে। সকালে যখন  বড় রাস্তার বাড়িতে  শুরু হয় চায়ের টুং-টাং, কলের জল, কোলের বাচ্চার ঝামেলা, ওই দিকে তখনও সব শান্ত, ঘুম ভাঙার সময় হয়নি ওদিকে তখন। ওদিকে যখন ধীরে ধীরে জানালা খোলা শুরু হয়, এদিকে তখন ভাত, ডাল , মাছের ঝোল এর পর্ব প্রায় শেষ। আর দুপুর নামতে নামতে ফারাকটা আরো বেশি বোঝা যায়, একদিক যখন দ্বিপ্রাহরিক ক্লান্তি তে ঝিমোয়, অন্যখানে তখন দিন শুরুর ব্যস্ততা।

এভাবেই চলে, পাশা-পাশি, কিন্ত  দূরত্ব বজায় রেখে। অনেকেই ভাবে, আরেকটু মাইনে বাড়লে এবার একটা ভালো জায়গা দেখে উঠে যাওয়া উচিত। তারপর মাসের শেষ, হিসেবের চাপে সব চাপা পরে যায়। এদিক সন্ধ্যায় শাঁখ বাজে, ওদিকে ভীড় জমা শুরু হয়। তারপর, আরো রাতে যখন মোড়ের মাথার পানের দোকানটা  বন্ধ হয়, তখন এই দুটো সমান্তরাল পৃথিবী এক মুহূর্তের জন্য একে  অপরকে ছুঁয়ে যায়। ওদিক থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দেয়া এক জোড়া পা টলতে টলতে এসে এবাড়ির দরজায় দাঁড়ায়,পায়  যত্নে বেড়ে দেয়া গরম ভাত। তারপর সেখানেও অন্ধকার নামে।

Leave a comment

Filed under Memoirs or Fiction?

Leave a comment