ঠিক যখন বিকেলটা সন্ধ্যে হব হব করে, তখন এখানে হয় বৃষ্টি নামে,নয় মনখারাপ।আর মাঝে মাঝে হাওা গুলো চলে যাওয়ার পথে এক রাশ পাতা হয়ত বেমাক্কা ছুড়ে দিয়ে চলে যায়। আমাদের নিপাট ভালমানুষ বাংলা সালের হিসেবে ২রা বৈশাখ। ঠিক যেমন গল্পে থাকে, সেই রকম একটা বৃষ্টি, আকাশের এক কোন থেকে কালো মেঘ ধিরে ধিরে পুরো আকাশটাকে কালো করে একটা অকাল-বিকেল নামিয়ে শুধুই ‘ঝম-ঝম-ঝম’। যেন ঠিকঠাক তৈরি হতে পারেনি, বাজ-বিদ্যুত কাউকেই খবর দেওয়া হয়নি, শুধু নিজেই তড়িঘড়ি নেমে পড়েছে।সারাটা দুপুর এভাবে বিকেল করে রেখে দেখি বেলা পড়তেই বৃষ্টি উধাও!চারদিক তখন চকচক করছে, যেন কেউ ঝাড়ন দিয়ে ভাল করে সব ধুলোবালি ঝেড়ে দিয়েছে।আর ঠিক তখনই,বিকেলটা যখন ‘এবার আসি’ বলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল, একটা হাওয়া এসে সব তছনচ করে ভালমানুষের মত ঘরের পাশের গাছের উপর বসে দোল খাওয়া শুরু করল, একবার এদিকে তো একবার ওদিকে!
পাশের বাড়ীর দাদু রোজ বিকেলে হাটতে যান।বেয়াদপ হাওয়াটা দেখি উনার ধুতি কে পতপত করে উরিয়ে দিচ্ছে!পায়ে জড়িয়ে পরলেন বলে!এই বয়েসে পরলে আর দাড়াতে পারবেন না যে! মা এক্ষুনি নিশ্চয় ছুটে গিয়ে ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনবেন।আমাদের ঠিকে কাজের লোকটা তিন দিন হল ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে, মায়ের বড় ধকল জাচ্ছে। বৃষ্টি থামলেই কাপড় মেলে দিচ্ছেন আর আবার মেঘ দেখলেই তুলে আনতে হচ্ছে-এসব বাড়িতে বড় কষ্ট। অই তো শুনতে পাচ্ছি ছাদে দাড়িয়ে কাকিমার সাথে এসব গল্পই করছেন।কি ইচ্ছে করছে একবার ছুটে ছাদে যেতে।আগে যখনই এভাবে মেঘ করত তখন দৌড়ে গিয়ে মেঘ দেখতাম, সাথে সুপুরি গাছের নাচ।
ঠিক সন্ধ্যার মুখে বৃষ্টি নামলে অন্ধকার যেন ঝুপ করে নেমে আসে।গলির মোড়ে পাড়ার ছেলে গুলো জমা হওার আগেই দেখি অন্ধকারটা ঘরে ঢুকে আলমারির পেছনে লুকিয়ে আছে।লাইট জ্বালালাম তাড়াব বলে, কিন্তু ব্যাটা দেখি টুক করে খাটের তলায় চলে গেল।ভাবলাম মা কে ডাকি, কিন্তু মায়ের কত কাজ।এক্ষুনি বাবা আসবেন।বাবা এলেই মা চা করবেন।চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাবা তো একবার আসবেন এখানে, রোজই আসেন।দেখে যান কি করছি, কেমন আছি।তখন না হয় বাবা কেই বলব ওটা কে তাড়িয়ে দিতে।
একটা সময় ছিল যখন এরকম দিনে মনে হত ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিশায়’।বলতে বেশির ভাগ সময়ই পারতাম না, কিন্তু কথা তো হত।কত্ত কথা!দরকারি, অদরকারি আরো অনেক।মা রাগ করতেন, ‘এত কথা কি, হ্যাঁ!’ তারপর হাসি চেপে চলে যেতেন। ওই এক মুহূর্তের লজ্জা যেন আদর মাখিয়ে দিয়ে যেত।লজ্জা পেলে নাকি অনেক কে দেখতে খুব সুন্দর দেখায়, আমাকে কেমন দেখায় কে জানে!আলমারির আয়না টা ঝাপসা হয়ে গেছে, অনেক দিন মোছা হয়নি।ঘরের আশে পাশে ছখ বুলিয়ে দেখলেই মনে হয় এখানে ধুলো মাকড়সার মত জাল বোনে। বুঝতে পারি, এই বয়েসে মায়ের পক্ষে তো আর সম্ভব নয়, কত করবেন! আর কাজের লোকের কথা তো আগেই বললাম, একদিন এলে দু দিন আসে না। তাদের তো আর ঘর বাড়ি থাকতে নেই!থাকলে আমাদের কি করে চলবে! এই যে গত কাল নববর্ষ গেলো, কি ঝামেলা হল কাজের লোক না থাকায়! রাঙ্গা পিসিমা আর ফুলমাসিমাকে আপ্যায়ন করার ব্যাস্ততায় মা ভুলেই গেলো যে পয়লা বৈশাখ টা আমার একলা বৈশাখ হয়ে গেল।কিন্তু কি করবেন। আমার কাছে আসতে গেলেই তো শুনতে হবে যে মেয়ে কে নিয়ে আদিখ্যেতা হচ্ছে।
হ্যাঁ, তবে ওরা এশেছহিলেন বইকি!সবাই একবার করে এসে শুনিয়েছেন অমুকের মেয়ে এটা করছেন, তমুকের মেয়ে ওটা করছে, আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের কত আশা ভরসা ছিল এবং কি করে আমি সব কিছু নষ্ট করে দিয়েছি।বাবা দরজার অপাশে দাড়িয়ে সব শুনছিলেন দেখেছি, কিন্তু কিছু যে বলবেন না তাও জানতাম।
এই তো দরজায় শব্দ হচ্ছে।বাবা এলেন বলে।কখন যে আবার আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে, বলতেই পারিনা।দরজা খুলতেই বৃষ্টির আওয়াজ আমার ঘর পর্যন্ত চলে এল!এক্ষুনি চায়ের কাপ নিয়ে বাবা আসবে আর কালকে সেই চুপ করে থাকার জন্য নিশ্চয় মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন।আমি বলব যে আমি একদম রাগ করিনি।অদের কষ্ট টাও তো বুঝতে পারি। ইচ্ছে করে কি আর কেউ আমাকে দুঃখ দেবে!আমি হেসে দিলেই বাবার মনের সব মেঘ কেটে যাবে, আমি জানি।আর লোকের কথায় বাবা কিছু না বল্লেও মুখের রেখায় যে কষ্ট গুলো ফুতে উঠে সেটা তো আমি দেখতে পাই, তাই রাগ করিনা।
ওই তো পায়ের শব্দ, রান্না ঘর থেকে এদিকে আসছে। কিন্তু আজকে দেখি একটু আগেই থেমে গেলো!তারপর সিঁড়ি ভাঙ্গার আওয়াজ পাচ্ছি জেন!বাবা কি তবে আসবে না আজকে?আমি যে কিছুই করিনি